আমার পিএইচডি জীবনের বয়স তিন বছরের সামান্য ওপরে। পাশ করার নয় মাসের মাথায় চলে এসেছিলাম- এর মধ্যে একবার ভার্সিটি বদল হয়েছে- সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতা খুব কম না। পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চমৎকার জায়গা (যদি পয়সাকড়ি দেয় আরকি)- কাজেই অভিজ্ঞতার বড় অংশই বেশ ভাল। সমস্যা হল, ভাল অভিজ্ঞতা শেয়ারে মজা নাই- খারাপগুলোর দুয়েকটা বরং শেয়ার করা যায়। অভিজ্ঞতাগুলোর সবই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা- অন্যদের জন্য ব্যতিক্রম হতেই পারে; কাজেই বেদবাক্য হিসেবে নেয়ার কোন প্রয়োজন নাই। অভিজ্ঞতাগুলো যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক- বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোন দেশের অভিজ্ঞতা নাই আমার।
দেশের জীবন আর প্রবাস জীবনে একটা বড় পার্থক্য আছে। দেশে আপনি আপনার পরিচিত পরিবেশ, পরিবার-বন্ধুবান্ধব থেকে যত দূরেই থাকেন, সেটার একটা লিমিট আছে- এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার খুব বেশি বড় না। অন্তত ডানেবামে দেশি মানুষ ত পাবেন যে কোন সময়। বিদেশের ব্যাপারটা এই দিক থেকে একটু ক্রিটিকাল। জীবনে পরপর দুইটা বাক্য ইংরেজিতে না বলা কাউকে ধরে ইংরেজদের রাজ্যে ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা বড় কষ্টকর। তার মধ্যে চাইলেই দেশে ফেরত যাওয়া সম্ভব না- আর সব বাদ দিলেও প্লেনের টিকেটের টাকা জোগাড় করতেই রক্ত পানি হয়ে যায়। খাবার-দাবারও অপরিচিত- এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে সবাই পিজা-বার্গার-কোক খায়, কিন্তু দেশের বাইরের পিজা-বার্গার-কোকও দেশের চেয়ে আলাদা। সব খাবারেই লবণ কম লাগে, সব খাবারই মিষ্টি, মশলা বলে কোন বস্তু নাই- এইসবের চেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে কী খাবেন এটা দোকানে গিয়ে বোঝাতে পারতে ত হবে! আপনি মনে মনে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে কিছু একটা বলবেন, দোকানের সার্ভার সেটা হাসিমুখে ধৈর্য ধরে শুনবে, শুনে বলবে, বুঝি নাই, আবার বল। আপনি আবার বলবেন, এবার একটু বেশি সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করে মাখিয়ে ফেলবেন এবং সে আরও কনফিউজড হয়ে আপনাকে আবার বলতে বলবে, ততক্ষণে আপনার খিদে চলে যাবে। যারা এটা পড়ে মনে মনে হাসছেন যে "যাশশালা খ্যাত দুই লাইন ইংরেজি বলতে পারে না" তারা হয় শিশুকাল থেকে ইংরেজি বলে অভ্যস্ত, আর নইলে জীবনে কখনো বিদেশি ভাষাভাষীর দেশে যান নাই। যারা নিজে রান্না করতে পারেন তাদের জন্য ব্যাপারটা একটু সহজ- কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বড় অদ্ভুত দেশ, এই দেশে গাড়ি ছাড়া বেশিরভাগ জায়গাতেই নড়াচড়া করা যায় না। দেশে আপনি "এই রিকশা" বলে ডাক দিয়ে বাজারে গিয়ে দরদাম করে মটরশুঁটি কিনে নিয়ে এসে সেটা বোয়াল মাছ দিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলেছেন হয়ত- এই দেশে সেটা কঠিন ব্যাপার। এখানে বাজারে যাওয়া একটা ফর্মাল ব্যাপারস্যাপারের মত- বিশেষ করে নতুনদের জন্য। যেহেতু আপনার গাড়ি নাই, আপনাকে এলাকার সব গাড়িওয়ালাকে রিকোয়েস্ট করতে হবে- তাদের কারো দয়া হলে সে আপনাকে বাজারে নিয়ে যাবে। সেই বাজার অনেকক্ষেত্রেই বাসা থেকে আধা ঘন্টা চল্লিশ মিনিট দূরে হবে এবং প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেটা হবে আমেরিকান দোকান- সেখানে পরিচিত মশলাপাতি কিছু পাবেন না। যা পাবেন সেটাই কিনে এনে বাসায় এসে রানা করে ফেলবেন; আপনি পাকা রাঁধুনি- তাতে হয়ত হলুদ-মরিচ-আদা-রসুন ছাড়াই রান্না কোনমতে উৎরে যাবে- কিন্তু সেটার চান্স কম- বরং রান্নার পর যেটা হবে সেটা গরমগরম আপনার প্রফেসরের মাথায় ঢেলে দিতে ইচ্ছা করবে। কয়েকদিন এইসব খেয়ে খেয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেলে আশেপাশে কোন এক ভারতীয় দোকানের সন্ধান পাবেন- সেখান থেকে আদা-রসুন-মরিচ-হলুদ-জিরা কিনে কষিয়ে ফার্মের মুরগি রেঁধে সেটা দিয়ে তিন বেলার ভাত এক বেলায় খেয়ে যখন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে যাবেন তখন খেয়াল হবে যে অলরেডি কয়েক মাস পার হয়ে গেছে এবং কোর্সওয়ার্ক-প্রজেক্ট-টিএ-আরএ'র ঠেলায় রোজ রান্না করা সম্ভব না। কাজেই এরপর থেকে সপ্তাহে একদিন রাঁধবেন এবং তার পরের ছয়দিন সেই এক রান্না ফ্রিজ থেকে বের করে মুখ বাঁকা করে খাবেন এবং কারো না কারোর চোদ্দগুষ্টির মুন্ডুপাত করবেন।
খাওয়ার সমস্যা আসলে সহ্য করে ফেলা যায়- যেটা সহ্য করা যায়না সেটা হল কথা না বলতে পারার কষ্ট। নিজের গল্প দিয়ে বোঝাই। যখন প্রথম বার্মিংহাম আসলাম, তখন ডিপার্টমেন্টের সকল বাংলাদেশির কোয়ালিফায়ার নামের এক দুঃস্বপ্ন চলে। নয়টা বিষয়ে পাঁচদিনের ম্যারাথন পরীক্ষা- সেই পরীক্ষার চাপে একজনের দশ কেজি ওজন কমে যেতে দেখেছি নিজের চোখে। কাজেই সবাই দিনরাত দরজা বন্ধ করে পড়ে, আর আমি একাএকা পথেঘাটে ঘুরে বেড়াই। প্রতিদিন দেশে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলি- সেটা ছাড়া বাকি পুরো সময় জবান বন্ধ। প্রথম কয়েকদিন কষ্ট করে সহ্য করে নিলাম- কিন্তু এক সপ্তার মাথায় মনে হল ধুশশালার সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দেশে চলে যাই। হয়ত চলেই যেতাম, কিন্তু পকেটে টিকেট কাটার মত পয়সা ছিল না- জীবনে ওই একবারই দারিদ্র্য সত্যি সত্যি কোন কাজে এসেছিল মনে হয়।
অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করতে আসেন- তাদের প্রফেসর নিয়ে খুব একটা ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন নাই। বড় অংশ আসেন পিএইচডি করতে- এবং যারা জানেন না তাদের জন্য বলি, পিএইচডির আগামাথা খুব বেশি নাই, এইটার বড় অংশই প্রফেসরের মর্জি। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডির কিছু রিকোয়ারমেন্ট আছে- কিন্তু সেগুলো মিনিমাম রিকোয়ারমেন্ট- বাকিটুকু আসলেই সত্যি সত্যি আপনার প্রফেসরের মর্জি। আপনাকে সপ্তায় বিশ ঘন্টা কাজ করার জন্য পয়সা দেয়া হবে- কিন্তু দেখা যাবে আপনি দিনরাত কাজ করছেন- সবাই করে। যদি না করেন তাহলে পিএইচডি আগাবে না, সাথে ফাউ হিসাবে সপ্তায় সপ্তায় প্রফেসরের ঝাড়ি খাবেন। আপনার প্রফেসর যদি ভদ্রলোক অথবা ভদ্রমহিলা হয় তাহলে হাসিমুখে ঝাড়ি দেবে, শাকচুন্নি হলে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এনে দেবে। এক-দুই সপ্তা কাজ না করে ভাবলেন ভুজুংভাজুং দিয়ে পার করে দেবেন- ওইটা ওই এক দুই সপ্তাই করতে পারবেন- তারপরেই বুঝবেন আপনার প্রফেসর আসলে ঘাঘু মাল- আপনার আগে আরও বহু গ্র্যাড স্টুডেন্ট দেখেছে সে, কাজেই ভুজুংভাজুং দেয়ার আগ্রহও চলে যাবে। আপনি যে বিষয়ে পিএইচডি করতে এসেছেন খুব ভাল সম্ভাবনা যে আপনার প্রফেসর সেই বিষয়েই পিএইচডি করেছেন এবং প্রতি সেমিস্টারে কয়েকশ ছাত্রকে সেই জিনিস রেগুলার পড়ান- কাজেই সাবজেক্ট নিয়ে ভুজুংভাজুং দেয়ার চেষ্টা করা সুইসাইডের পর্যায়ে পড়ে। চরম উদাস ভাইয়ের একটা লেখায় পড়েছিলাম- প্রফেসর তিন রকমঃ মন্দ, অতি মন্দ আর অতিশয় মন্দ। এই পর্যায়ে এসে সেই কথাকে বেদবাক্য মনে হতে পারে। তবে সুবিধা হল, এই এক লোকের সাথেই আপনাকে টানা কয়েক বছর কাজ করতে হবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার ভাবগতিক ধরে ফেলবেন আপনি। আপনি জানবেন সে কখন রোজ অফিসে আসে, কখন যায়, কখন তাকে গুঁতালে ভাল মেজাজে পাওয়া যাবে, কখন তার সামনে উপস্থিত হওয়াই যাবে না এইসব ব্যাপারস্যাপার। আপনি যদি দেশে চাকরি করে থাকেন তাহলে এটা আপনার জন্য কোন ব্যাপারই না, কারণ দেশে কোথাও না কোথাও কোন এক সাড়ে হারামজাদা বসকে আপনার সামলাতে হয়েছে- সে জায়গায় আপনার প্রফেসর ঋষিতুল্য মানুষ। এই পুরো ভজঘটের একটা সিলভার লাইনিং আছে অবশ্য- প্রফেসরের ঠ্যালা খেয়ে খেয়ে দিনরাত কাজ করে করে আপনার পিএইচডি সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাবে- আপনিও নামের আগে ডাক্তার লাগিয়ে ফিফি করে কিছুদিন পার্ট নিতে পারবেন।
এখন আপনি যদি সৌভাগ্যবান হন, তাহলে আমার প্রফেসরের মত অতিশয় ভাল কোন মানুষকে প্রফেসর হিসেবে পেয়ে যেতে পারেন যে আপনাকে ওয়ার্ক আওয়ারের পরে মেইল দেবে না, উইকেন্ডে ল্যাবে আসেন নাই কেন সেটা নিয়ে কপচাবে না, প্রতি সেমিস্টারে পেপার হচ্ছে না কেন সেটা নিয়ে চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে না, কোর্সওয়ার্ক করতে টাইম দেবে, ফাউফাউ কনফারেন্সে পাঠাবে জিনিসপত্র শিখতে, কোন সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হলে মুখ ঝামটা না দিয়ে ধৈর্য ধরে শেখাবে। এখন আপনি যদি আমার মত হন তাহলে আপনি এই ভালমানুষির সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবেন এবং দীর্ঘদিন এই সুবিধা নেওয়ার পর বুঝতে পারবেন যে এভাবে চললে আপনার পক্ষে পাঁচ বছর কেন, অনন্তকালেও পিএইচডি শেষ করা সম্ভব না।
সব পিএইচডি স্টুডেন্ট বাধ্যতামূলকভাবে প্রফেসরদের জাতীয়তা নিয়ে একটা জেনারেলাইজেশন করে- আমিও এর ব্যতিক্রম না। উদাহরণ দেই- চাইনিজ প্রফেসরদের ব্যাপারে সবার দাবি হচ্ছে এরা খাটিয়ে খাটিয়ে স্টুডেন্টদের রক্ত-মাংস এক করে ফেলে- যেটা কেউ বলে না যে এরা নিজেরাও খাটতে খাটতে নিজেদের রক্ত-মাংস এক করে ফেলছে বহু বছর ধরে। এই খাটাখাটনির ব্যাপারটা আসলে শুধু চাইনিজদের জন্য সত্যি না অবশ্য। এই দেশে আমি যত প্রফেসরের সাথে কাজ করেছি সবাই অসুরের মত খাটেন- রাত দিন এই কনসেপ্টগুলো তাদের কাছে অনেক সময়ই খুব একটা পরিষ্কার না- তাই তারা সময়ে অসময়ে ছাত্রদের কাছ থেকে কাজের ফিরিস্তি চেয়ে বসেন। কাজেই "বেশি খাটায়" এই ক্রাইটেরিয়া দিয়ে প্রফেসর বাদ দিতে চাইলে দিনের শেষে কপালে শনি থাকাটা অসম্ভব কিছু না। তিন বছর ধরে এসব দেখে তাই জেনারেলাইজ করা বাদ দিয়েছি এখন- সবাইকে সমানভাবে গালি দেওয়ার মধ্যেও একটা শান্তি আছে। তারপরেও একটা জায়গায় জেনারেলাইজেশন ছাড়তে পারিনি- স্বদেশি প্রফেসর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি এখনও। এদেশে প্রফেসররা বেশিভাগক্ষেত্রেই আপনার সাথে সহকর্মীর মত ব্যবহার করবেন- শিক্ষক অথবা বসের মত না। প্রথম-প্রথম একটু অস্বস্তি লাগবে, কিন্তু কিছুদিন পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আপনি খুব সহজভাবে তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করতে পারবেন, হাসি-ঠাট্টাও করতে পারবেন। এই জিনিসটা সম্ভবত স্বদেশি প্রফেসরদের জন্য সত্যি না- তারা আমাদের দেশের শিক্ষকদের মতই একটা সুপিরিয়রিটি বজায় রাখেন বলে শুনেছি- দেশের শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার কারণে তাই স্বদেশি শিক্ষকদের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করিনি কখনও।
(আমার প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা শেয়ার করার কথা ছিল- সেটা না করে লাইফ এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করে ফেলেছি। ক্ষমা করতে আজ্ঞা হয়)