উন্নত জীবনব্যবস্থা, কম্পিটিটিভ স্যালারির পাশাপাশি গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, অ্যামাজন এর মত গ্লোবাল কর্পোরেশনগুলোতে জব করার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে নানাবিধ ওয়ার্ল্ড ট্রান্সফরমিং টেকনোলজি তৈরি এবং একি সাথে বাজারজাতকরন প্রক্রিয়ার সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের অনন্য সুযোগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এইসব প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস থাকলেও, এরা মূলত ইউএস কেন্দ্রিক হওয়ায় এদের সবচাইতে বড় এমপ্লয়ি হাব ইউএস-এতেই। স্বভাবতই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এরা সরাসরি এমপ্লয়ি রিক্রুট করে। এই ধরনের রিক্রুটমেন্ট ইন্টারভিউগুলো সাধারণত দুই ধাপে হয়। আপ্লিকেশনের পরে প্রাথমিক বাছাইয়ে নির্বাচিত হলে "ফোন" ইন্টারভিউের ডাক আসে।
ফোন ইন্টারভিউগুলো কখন এক দফা আবার কখনও কয়েক দফা হয়। ফোন ইন্টারভিউগুলোতে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে ইন্টারভিউয়ার ফোনে অথবা স্কাইপে কল করে ইন্টারভিউ নেয়। একেক প্রতিষ্ঠানের ফোন ইন্টারভিউএর ধরন একেক রকম। বেশীরভাগ সময়ই এক একটা সেশন প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চলে এবং নানান প্রোগ্রামিং ও এলগরিদম বিষয়ক সমস্যার সমাধান করতে দেয়।
পরের ধাপ হচ্ছে "অন সাইট" ইন্টারভিউ। "ফোন" ইন্টারভিউতে নির্বাচিত হলে ওরা পরবর্তী ধাপে, ওদের সুবিধামত কোন দেশের কোন একটা অফিসে আমন্ত্রণ করে, যেটা "অন সাইট" ইন্টারভিউ নামে পরিচিত। "অন সাইট" ইন্টারভিউ দিনব্যাপী কয়েকটা সেশনে বিভক্ত থাকে (তিন থেকে চারটা, ক্ষেত্রও বিশেষে পাঁচটাও হতে পারে)। এখানেও প্রতিটা সেশন চলে প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে। একেকটা সেশনের মুল থিম একেক রকম থাকলেও সবগুলোতেই প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, এলগরিদম, ডাটা-স্ট্রাক্টার, প্রবলেম সল্ভিং ক্ষমতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়। সাধারণত এই ধরনের রিক্রুটমেন্টের সময় ওরা অতিরিক্ত সতর্ক থাকে (এক্ষেত্রে ওদের রিস্ক এবং লায়বিলিটি দুইটাই অনেক বেশী থাকে), যে কারণে অনেক ভালো ভালো ক্যান্ডিডেটও কঠোর বাছাই প্রক্রিয়ায় বাদ পড়ে যায়। তারপরও আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর অনেকেই এই সবকিছুর বাঁধা বিপত্তি পার হয়ে সরাসরি জব নিয়ে ইউএস আসে।
দেশ থেকে যারা সরাসরি ইউএস-এর সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোতে এরকম চাকুরী নিয়ে আসতে চায় তাদের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল এক্সট্রাঅরডিনারি প্রবলেম সল্ভিং স্কিল অথবা এক্সট্রাঅরডিনারি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পোর্টফোলিও।
তবে ইউএস থেকে যারা এমএস অথবা পিএইচডি করে তাদের জন্য ব্যাপারটা আরেকটু সহজ।
ইউএস বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত সামারে প্রায় তিনমাস বন্ধ থাকে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে স্টুডেন্টদের অনেকেই বিভিন্ন কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করতে যায়। এদেশের কোম্পানিগুলোর এমপ্লয়মেন্ট প্রসেস অনেকটাই এই ইন্টার্নশিপ নির্ভর। কোম্পানির আকার যত বড় তাদের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামগুলোও তত বড় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ থাকে। গ্লোবাল কর্পোরেশনগুলোর জন্যও একই কথা প্রযোজ্য, কারণ এদেরও ভবিষ্যৎ এমপ্লয়ি রিক্রুটমেন্টের বিশাল অংশ এদের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামগুলোর সাফল্যের উপর নির্ভর করে। এই ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামগুলো এমপ্লয়ার ও স্টুডেন্ট দুই পক্ষের জন্যই সমান লাভজনক। এমপ্লয়াররা সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেটদের তিনমাস ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পায়। আর ক্যান্ডিডেটরাও লম্বা সময় ধরে তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারে। এর ফলে দেখা যায় তিনমাস-এর ইন্টার্নশিপ শেষে বেশীরভাগ ক্যান্ডিডেটই ফুলটাইম জব অফার নিয়ে ফেরত আসে। এতে করে তাদের পাস করার প্রায় ১ বছর আগেই জব কনফার্ম হয়ে যায়, ফলে আর পাস করে চাকুরী খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। ইন্টার্নশিপএর ইন্টারভিউগুলো ফুল্টাইম জব ইন্টারভিউএর তুলনায় কিছুটা সহজ হয়। এগুলোর বেশিরভাগই কয়েকটা সেশনএর ফোন ইন্টারভিউ। আমার জানা মতে অন সাইট ইন্টারভিউ খুব একটা হয় না। স্বভাবতই, এইসব ইন্টার্নশিপএর ক্ষেত্রে যারা শীঘ্রই গ্র্যাজুয়েশন করবে তাদের প্রায়োরিটি বেশী থাকে।
ইউএস গ্র্যাজুয়েটদের আরেকটা বড় সুবিধা হল ইউনিভার্সিটি কর্তৃক আয়োজিত "জব ফেয়ার"। ইউএস বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি বছর অন্তত দুটো “জব ফেয়ার” আয়োজন করে। এই জব ফেয়ারগুলোতে বড় থেকে মাঝারি ও ছোট সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই জাঁকজমকপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করে। এই জব ফেয়ার গুলোর অন্যতম ভালো দিক হচ্ছে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপ্লয়ি / রিক্রুটারদের সাথে সরাসরি ভাব বিনিময়ের সুযোগ। সুতরাং, এইসব "জব ফেয়ার"-এ নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারলে নিদেনপক্ষে ইন্টারভিউ কল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ছোট (স্টার্টআপ) এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ইউএসএর ভেতর থেকেই এমপ্লয়ি রিক্রুটমেন্ট পছন্দ করে। আর এদের সংখ্যাই সবচাইতে বেশী, তাই এখানে অপশনও অনেক অনেক বেশী।
যারা এখন বাংলাদেশে কম্পিউটার সাইন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আন্ডারগ্র্যাড করছে অথবা সদ্য পাস করেছে, তাদের জন্য দুটো ধাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ,
আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারনা থাকে যে কম্পিউটার সাইন্সে রেজাল্ট খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, ভালো প্রোগ্রামিং জানলেই চলে। এই ধারনাটা সিগারেটের মতই আকর্ষণীয় এবং ক্ষতিকর। বিজ্ঞানী, প্রফেসর অথবা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ক্যারিয়ার হিসেবে যেটাই পছন্দ হোক না কেন, এখনকার প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ভালো প্রোগ্রামিংএর পাশাপাশি ভালো জিপিএ ধরে রাখা সবার জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ (অবশ্য এন্টারপ্রেনরদের কথা আলাদা)। হুম, তুমি যদি খুবই ভালো প্রোগ্রামার হও, খুবই ভালো প্রোগ্রামিং পোর্টফোলিও, অথবা খুবই ভালো রিসার্চ পোর্টফোলিও থাকে তাহলে হয়ত অন্য কথা। তবে আবার এমন না যে ভালো জিপিএ ছাড়া দুনিয়া অন্ধকার বা ভালো জিপিএ হলে আর কিছুই লাগবে না। লজিকটা খুবই প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল।
তোমার কোন ক্রেডেন্সিয়াল অ্যাভারেজ থেকে নিচু হলে, তুমি নিজেকে এভারেজ প্রমাণ করতে হলেও তোমার অন্য কোন ক্রেডেন্সিয়াল এভারেজের চেয়ে ভালো হতে হবে।সুতরাং একটু চেষ্টা করলে যদি আরেকটু ভালো সিজিপিএ তোলা যায়, তাহলে কেন নয়?
যাদের আন্ডারগ্র্যাড শেষ কিন্তু অত ভালো সিজিপিএ নাই তাদেরও হতাশ হওয়ার কোন কারণ নাই। ইউএসএতে এমএস অথবা পিএইচডি অ্যাডমিশনএর জন্য সিজিপিএ ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধাপ আছে, যেমনঃ জিআরই, টোফেল, ইউনিভার্সিটি সিলেকশন, প্রফেসর সিলেকশন, প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ, স্টেটমেন্ট অব পারপাস লিখা, যথাযথ রিকমেন্ডেশন জোগাড় করা, ইত্যাদি। এর প্রতিটা ধাপে যথাযথ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন অভূতপূর্ব সফলতা এনে দিতে পারে। অ্যাপ্লাই করার ক্ষেত্রে যদি পিএইচডি করার একান্ত ইচ্ছা না থাকে তাহলে এমএসএর জন্য অ্যাপ্লাই করাই ভালো। এক্ষেত্রে ইউনিভারসিটি র্যাংকিং তত গুরুত্বপূর্ণ না, অ্যাডমিশনই আসল। আর্থিক সচ্ছলতা থাকলে (নিজ টাকায় দুই বছর চলার মত) স্কলারশিপও তত গুরুত্বপূর্ণ না। আমাদের দেশে যেমন একটা সামাজিক স্টিগমা আছে যে স্কলারশিপ ছাড়া বাহিরে পড়তে যাওয়াকে কেমন যেন একটু তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা। এখানে আসার পর দেখি, প্রচুর ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজ ছেলে মেয়ে স্কলারশিপের আশায় বসে না থেকে, নিজের টাকায় এমএস করছে। এদের বেশীরভাগই দেশ থেকে শিক্ষাঋণ নিয়ে পড়তে আসে অথবা দেশে কয়েক বছর চাকুরী করে অর্থ জমিয়ে সেটা নিয়ে এখানে পড়তে আসে। পরে এখানে এসে অনেকেই অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ জোগাড় করে আবার অনেকেই এভাবেই চালিয়ে যায়। যারা শিক্ষাঋণ নিয়ে পড়তে আসে, তারা পরে জব পেয়ে ঋণ পরিশোধ করে দেয়। আশার ব্যাপার হল, যথেষ্ট যোগ্যতা এবং ডেডিকেশন থাকলে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দুই/এক সেমিস্টার পরই অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ জোগাড় করা সম্ভব।
আর যারা নতুন নতুন কম্পিউটার সাইন্সে আন্ডারগ্র্যাড করতে আসতেছে তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আশেপাশে খুব একটা না তাকিয়ে নিজের গোলএ ফোকাসড থাকা। বিজনেস, ইকোনমিক্স ও সাইন্সে "এইটি-টুয়েন্টি রুল" নামে মজার একটা থিওরি আছে। যেটার মুল বক্তব্য হলঃ "Roughly 80% of the effects come from 20% of the causes"। এই থিওরির এক পিঠে যেমন লিখা "বিশ ভাগ চেষ্টাতেই আশিভাগ সফলতা পাওয়া সম্ভব", ঠিক অন্য পিঠে লিখা, "বাকি বিশভাগ সফলতার জন্য, বাকি আশিভাগ চেষ্টার প্রয়োজন হয়।" অথচ আমরা যখন নতুন নতুন বুয়েট কম্পিউটার সাইন্সে ভর্তি হই, আমাদের মধ্যে যে ধ্যানধারনা প্রস্ফুটিত হয়েছিল তা ছিল এর থেকে একদমই আলাদা। তখন আমরা অনেক বিখ্যাত সব আলাম্নাই-এর গল্প শুনতাম। রূপকথার মত একেকটা গল্প। আর এইসব গল্প শুনে শুনে আমাদের মধ্যে একটা বদ্ধমুল ধারনা হয় যে, গিফটেড মানুষজনের বেশী কিছু করতে হয় না। এদের অল্প চেষ্টাতেই এরা সাধারণ মানুষ থেকে অনেক বেশী আউটপুট প্রডিউস করতে পারে। কিন্তু সমস্যা বাধল, আমাদের মধ্যে যারা গিফটেড তাদের কীভাবে সনাক্ত করা যাবে? একটা উপায় হল, কারা কত কম কাজ করে কত বেশী আউটপুট প্রডিউস করতে পারে তাদেরকে খুঁজে বের করা। এই মানদণ্ডে কেউ গিফটেড হইলে তো খুবই ভালো, সে সবার মধ্যমনি, নয়নমণি।
কিন্তু অবিশ্বাস্য হইলেও সত্যি যে, অন্যদের এই রকম অ্যাটিচ্যুড-এর কারণে অনেকেই নিজেকে "মিডিওকোর" ভেবে ডিমটিভেটেড হয়ে যেত।কারণ তার ধারণা, তার যেকোনো কোন আউটপুট প্রডিউস করার জন্য অন্যদের চাইতে বেশী খাটতে হয়, সুতরাং সে "গিফটেড এনাফ" না। ফলস্বরূপ, কেউ কেউ প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে গিয়ে শুরুতেই আশানুরূপ ফলাফল না পেয়ে, আবার কেউ কেউ স্রেফ অন্যদের চেয়ে বেশী পড়তে হয় এই কারণে হতাশ হয়ে এক সময় চেষ্টা করাই ছেড়ে দেয়। অথচ আমাদের একটু ভিন্ন মনোভাব থাকলে অথবা সংকল্প একটু দৃঢ় থাকলে, হয়ত অনেকের পক্ষেই ভালো প্রোগ্রামিং দক্ষতার পাশাপাশি একটা ভালো সিজিপিএ ধরে রাখাও অসম্ভব কিছু ছিল না।